ইতিহাস

যে কোন মহৎ সৃষ্টির পেছনে থাকে মহৎ উদ্যোগ। ভান্ডারিয়া থানা এবং সংলগ্ন অন্যান্য অঞ্চলের বিদ্যোৎসাহী জনগণ এবং সরকারি কর্মচারী-কর্মকর্তাগণ দীর্ঘদিন যাবৎ অবহেলিত এই জনপদে উচ্চ শিক্ষা প্রসারের জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ কলেজ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন। বিদ্যোৎসাহী উদ্যোগী ব্যক্তিদের মধ্যে ছিলেন খান সাহেব আঃ মজিদ জোমাদ্দার, বাবু রাজেন্দ্র কুমার মজুমদার (ভূমিদাতা), জনাব খবির উদ্দিন সিকদার, জনাব এম.এ বারী (তৎকালীন সাবরেজিস্ট্রার), জনাব সিরাজুল হক (অগ্রণী ব্যাংকের ম্যানেজার), জনাব এস. আর চৌধুরী (তৎকালীন ভান্ডারিয়া থানার ও.সি) প্রমুখ।

তৎকালীন সময়ে ভান্ডারিয়া থানার সাবরেজিস্ট্রার জনাব এম.এ বারী আহবায়ক হিসাবে ৩১/০৫/১৯৭০ইং সালে স্থানীয় ডাকবাংলো চত্ত্বরে একটি পাবলিক মিটিং আহবান করেন। সভায় উপরে উল্লিখিত ব্যক্তিবর্গ ছাড়াও ভান্ডারিয়ার বহু গণ্যমান্য ব্যক্তি যেমনঃ মরহুমা বেগম তোফাজ্জল হোসেন, মরহুম জনাব আব্দুল মান্নান হাওলাদার, ব্যারিস্টার জনাব মইনুল হোসেন, মরহুম আশরাব আলী তালুকদার, আঃ রশিদ খাঁন, খান এনায়েত করিম, ভান্ডারিয়া থানা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, তৎকালীন পুলিশ অফিসার, সার্কেল অফিসার (উন্নয়ন) প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। উক্ত সভায় সর্বসম্মতিক্রমে চাঁদা আদায়ের মাধ্যমে কলেজ প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। অনেকেই স্বতঃস্ফূর্তভাবে চাঁদা প্রদান করায় ৩৪০০০/-(চৌত্রিশ হাজার) টাকা সংগৃহীত হয়। কলেজের নাম নির্ধারিত হয় ভান্ডারিয়া কলেজ।

কলেজে শিক্ষক নিয়োগ প্রসঙ্গে শুরুতেই বাবু সুবোধ কুমার বল মহাশয়ের কথা উঠে। ভান্ডারিয়া বিহারী হাই স্কুলের সুধী শিক্ষক জনাব আনসার উদ্দিন গাজী সাহেবের প্রস্তাবনায় তিনি শিক্ষকতায় রাজি হলে তাঁর উপরই কলেজের কার্যক্রম শুরু করার দায়িত্ব পড়ে। তিনি নির্দেশমত ভান্ডারিয়া বিহারী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের বোর্ডিং কক্ষে কলেজের প্রাথমিক কাজ শুরু করেন এবং ১৯৭০-১৯৭১ শিক্ষাবর্ষে একাদশ শ্রেণীতে ছাত্র ভর্তি কার্যক্রম শুরু হয়। ইতোমধ্যে বাবু রাজেন্দ্র কুমার মজুমদারের প্রচেষ্টায় ও সহযোগিতায় জনাব সৈয়দ হাবিবুল আহসান অধ্যক্ষ হিসাবে যোগদান করেন। এরপরে প্রভাষক হিসাবে যোগদান করেন জনাব আব্দুল কাদের, জনাব বীরেন্দ্র নাথ সিকদার, জনাব গোলাম মোস্তফা, জনাব শান্তিরঞ্জন বিশ্বাস,জনাব তুষার কান্তি দাস,জনাব আনোয়ার হোসেন প্রমুখ।

কলেজের কাজ পুরোদমে চলতে থাকে। ০১/০৭/১৯৭০ ইং তারিখে কলেজটি মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষাবোর্ড, যশোর কর্তৃক অনুমোদন পায়। তখনও কলেজের নিজস্ব কোন ঘর তৈরি হয়নি। কলেজ পরিদর্শকের রিপোর্ট অনুযায়ী বাধ্য হয়ে কলেজটিকে স্কুল বোর্ডিং ত্যাগ করতে হয়। অপরিহার্যভাবে কলেজের নিজস্ব ভূমির প্রয়োজন দেখা দেয়। তখন সাময়িকভাবে ইউনিয়ন পরিষদের কক্ষে ও উন্মুক্ত ছাদে তাবুর নিচে শ্রেণী কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়া হয়। কলেজের জমির প্রয়োজনে স্থানীয় কোন্দলের উর্ধ্বে থেকে শ্রদ্ধেয় বাবু রাজেন্দ্র কমুার মজুমদার কলেজের জন্য জমিদান করেন। তাঁরই অক্লান্ত পরিশ্রমে তিনখানা গোলপাতার ছাউনি ঘর তৈরি করা হয়। জনাব মোকলেছ মিয়া, জনাব আনছার মিয়া, বাবু নরেন্দ্র নাথ রায় প্রমুখ ব্যক্তিও কলেজের জন্য জমিদান করে ধন্য হয়েছেন। ইউনিয়ন পরিষদের উন্মুক্ত ছাদ থেকে কলেজের অফিস নিজস্ব জমিতে স্থানান্তরিত হয়।

ইতোমধ্যে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু হয়। পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর ভয়ে অনেক শিক্ষক-কর্মচারী পালিয়ে বেড়ান। লুট হয় কলেজের বিজ্ঞানাগারের যন্ত্রপাতি ও রাসায়নিক দ্রব্যাদি। তৎকালীন পাকিস্তান সরকার মুসলিম শিক্ষকদের দ্বারা কিছুদিন ক্লাস চালু রাখেন। দেশ স্বাধীনের পর যুদ্ধ বিধ্বস্ত সারা বাংলাদেশ জুড়ে ক্ষতিগ্রস্তদের সাহায্য ও সহযোগিতা করার জন্য রিলিফ কমিটি গঠিত হলে- পিরোজপুর জেলা রিলিফ কমিটির চেয়ারম্যান এডভোকেট এনায়েত করিম এম.পি, জনাব নূরল ইসলাম বেপারী, থানা রিলিফ কমিটি ও তৎকালীন ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানবৃন্দ মরহুম জনাব মোফাজ্জল হোসেন (চানমিয়া), জনাব আঃ রশিদ খান, জনাব মানিক হাওলাদার, জনাব জলিল তালুকদার, জনাব নুর মোহাম্মদ হাওলাদার, জনাব মান্নান ও মরহুম জনাব কাজী নুরুজ্জামান সাহেবের (তৎকালীন আওয়ামী লীগ সভাপতি) সহযোগিতায় কলেজের ঘরের গোলপাতার ছাউনি পরিবর্তন করে টিনশেডে রুপান্তরিত করা হয় এবং কলেজের ভূমি সংস্কারের জন্য গম বরাদ্দ করা হয়।

ইতোমধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৭২-১৯৭৩ শিক্ষাবর্ষে ডিগ্রি (পাস) কোর্সে (মানবিক ও বাণিজ্য) ভর্তির অনুমোদন প্রদান করা হয়। কিন্তু অভাব দেখা দিয়েছিল ছাত্র-ছাত্রীর। সিদ্ধান্ত মোতাবেক অধ্যক্ষ জনাব হাবিবুল আহসান কলেজের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ সমন্বয়ে ছাত্র-ছাত্রী সংগ্রহ টিম গঠন করে গ্রামে গ্রামে ছাত্র-ছাত্রী সংগ্রহে বের হন। একাজের পরিপ্রেক্ষিতে সর্বমহলে অচিন্ত্যনীয় সাড়া জাগে এবং প্রায় ১২০ জন শিক্ষার্থী নিয়ে ঐ শিক্ষাবর্ষেই স্নাতক পর্যায়ে শিক্ষার শুভ সূচনা হয়। প্রথম থেকেই শিক্ষক ও কর্মচারীদের বেতন ছিল সামান্য। অধ্যক্ষ জনাব হাবিবুল আহসান, জনাব হাবিবুর রহমান, জনাব শান্তিরঞ্জন বিশ্বাস, জনাব আনোয়ার হোসেন, জনাব কাদের মিয়া, জনাব সুবোধ কুমার বল, জনাব বীরেন্দ্র নাথ সিকদার, জনাব হালিম উকিল কলেজের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে সামান্য পারিশ্রমিকে শ্রী রাজেন্দ্র বাবুর তৈরী ডরমিটরীতে কোন রকম থেকেছেন।

শিক্ষক ও কর্মচারীদের সামান্য বেতন দেয়ার মত আর্থিক স্বচ্ছলতা সবসময় কলেজের ছিলনা। ইতোমধ্যে কলেজে দারুন অর্থ সংকট দেখা দেয়। শিক্ষকগণ টিম গঠন করে ভান্ডারিয়ার প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে ধান সংগ্রহের ব্যবস্থা করেন। কলেজের এই আর্থিক সংকট মোচনের জন্য এই উপমহাদেশের প্রখ্যাত সাংবাদিক দৈনিক ইত্তেফাকের প্রতিষ্ঠাতা মরহুম তোফাজ্জেল হোসেন মানিক মিয়ার জ্যেষ্ঠ পুত্র ব্যারিষ্টার জনাব মইনুল হোসেন দৈনিক ইত্তেফাকের পক্ষ থেকে বছরে একটি নির্দিষ্ট পরিমান অর্থ দেয়া শুরু করেন। এছাড়া ভান্ডারিয়া সাব রেজিস্ট্রি অফিসে যারা জমিজমা ক্রয় করতেন তাদের কাছ থেকেও চাঁদা সংগ্রহের ব্যবস্থা ছিল। ভান্ডারিয়া থানাকে উপজেলায় উন্নীত করার পর শিক্ষা বিস্তারকল্পে ভান্ডারিয়া কলেজের পাকা ভবন নির্মাণের জন্য উপজেলা পরিষদ সিদ্ধান্ত নেয়। তৎকালীন নির্বাহী কর্মকর্তা মিঃ তড়িৎ কান্তি রায় চৌধুরীর আন্তরিক প্রচেষ্টায় বিশাল একাডেমিক ভবনের নির্মাণ কাজ অনেকটা এগিয়ে যায়।

কলেজের অর্থনৈতিক দুর্দিনে বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা, গণতন্ত্রের পূজারী বিশিষ্ট দেশপ্রেমিক ভান্ডারিয়ার অবিসংবাদিত নির্ভীক ব্যক্তিত্ব জান্নাতবাসী মানিক মিয়ার কনিষ্ঠ পুত্র দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকার সম্পাদক জনাব আনোয়ার হোসেন মঞ্জু পিতৃভূমি ভান্ডারিয়ায় এলে কলেজের শিক্ষক ও ছাত্রদের পক্ষ থেকে বিপুল সংবর্ধনা দেয়া হয় এবং তাঁকে কলেজের আর্থিক অস্বচ্ছলতার কথা জানানো হয়। তখন তিনি কলেজকে ব্যক্তিগত তহবিল থেকে কিছু অর্থ দান করেন। পরবর্তীতে তিনি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের জ্বালানী ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়ে ভান্ডারিয়ায় এলে তাঁকে কলেজের পক্ষ থেকে বিপুল সংবর্ধনাসহ কলেজটিকে সরকারিকরণের অনুরোধ করা হয়। তিনি সবরকম সাহায্যে আশ্বাস দেন। এরপর ১৯৮৫ সালের ৮ই মে তৎকালীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ভান্ডারিয়া বিহারী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের মাঠে বিশাল জনসভায় ভান্ডারিয়া কলেজটিকে তিনি সরকারি কলেজ হিসাবে ঘোষনা দেন এবং ০১/০৭/১৯৮৫ ইং তারিখ থেকে সরকারি কলেজের মর্যাদা লাভ করে।

সরকারিকরণের পর বেসরকারি আমলের অধ্যক্ষ জনাব সৈয়দ হাবিবুল আহসান ২২/০৩/১৯৮৭ ইং তারিখ পর্যন্ত অফিসার ইন-চার্জ হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি বাগেরহাট সরকারি পি.সি কলেজে বদলী হলে প্রবীণ শিক্ষক বাবু সুবোধ কুমার বল অফিসার ইন চার্জ হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। সরকারি হওয়ার পর ১৪/০১/১৯৯২ ইং তারিখে জনাব ফজলুল করিম আকন্দ সাহেব প্রথম অধ্যক্ষ হিসাবে যোগদান করেন।

বর্তমান কলেজ অধ্যক্ষ প্রফেসর মো. আমানউল্লাহ খান ৩০/০৯/২০২১ খ্রি. তারিখে যোগদান করেন। বর্তমানে কলেজে শিক্ষার পরিবেশ অত্যন্ত চমৎকার। শিক্ষক স্বল্পতা শিক্ষার্থীদের পাঠদান ও কলেজে সার্বিক শিক্ষার পরিবেশ গঠন ও শৃঙ্খলা বিনির্মাণে অন্তরায় হলেও আশা করা যায় সরকারের আশু সুদৃষ্টি অনতিবিলম্বে শূন্য পদ সমূহ পূরণের মাধ্যমে অত্র অঞ্চলের শিক্ষা বিস্তারে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে।